শসা চাষ পদ্ধতি ও সঠিক যত্ন
আমাদের আজকের আর্টিকেল টি হচ্ছে শসা চাষ পদ্ধতি নিয়ে।
শসা চাষ আমাদের দেশের অন্যতম জনপ্রিয় সবজি চাষের মধ্যে একটি। গ্রীষ্মকালীন সবজি হলেও শসা প্রায় সারা বছরই চাষ করা যায়। শসা চাষের মাধ্যমে কৃষকরা সহজেই অর্থ উপার্জন করতে পারেন, কারণ বাজারে শসার চাহিদা বেশ ভালো থাকে। এই নিবন্ধে আমরা শসা চাষের সমস্ত পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব যা সফলভাবে শসা চাষের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।
শসা চাষের উপযোগী জলবায়ু ও মাটি
শসা গরম জলবায়ুতে ভাল ফলন দেয়, তবে উষ্ণ এবং আর্দ্র আবহাওয়া এই সবজি চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। শসা চাষের জন্য আদর্শ তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
শসা চাষের জন্য দোআঁশ মাটি সর্বোত্তম। তবে বেলে-দোআঁশ মাটিতেও এটি ভাল ফলন দিতে পারে। মাটির পিএইচ ৫.৫-৬.৭ হওয়া প্রয়োজন, কারণ অম্লতা বা অতিরিক্ত ক্ষারীয় মাটি শসার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। শসা চাষের মাটিতে জৈব সার প্রয়োগ করা উচিত যাতে মাটি উর্বর থাকে এবং শসা ভালোভাবে বেড়ে ওঠে।
শসা বীজ বপনের সময় ও পদ্ধতি
শসা চাষ সাধারণত গ্রীষ্মকালে শুরু করা হয়। ফেব্রুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সময় শসা বপনের জন্য আদর্শ। তবে যারা শীতকালে চাষ করতে চান, তারা অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে বপন করতে পারেন।
শসা চাষের জন্য প্রথমে জমিকে ভালোভাবে চাষ করতে হবে। জমি সমান করে বীজ বপনের পূর্বে জৈব সার মিশিয়ে নিতে হবে। শসা বীজ প্রায় ১.৫-২.০ সেন্টিমিটার গভীরতায় মাটিতে পুঁতে দিতে হবে। সারির মধ্যে ৯০ সেমি এবং গাছের মধ্যে ৪৫ সেমি দূরত্ব রাখা উচিত যাতে গাছগুলি পর্যাপ্ত স্থান পায় এবং সহজে বেড়ে উঠতে পারে।
সারের ব্যবহার
শসা চাষে সঠিক মাত্রায় সার ব্যবহার করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জৈব সার, যেমন গোবর বা কম্পোস্ট সার প্রয়োগ করলে মাটির উর্বরতা বাড়ে। এছাড়া শসা চাষের জন্য ইউরিয়া, টিএসপি, এবং এমওপি সারও প্রয়োজন। প্রতি হেক্টরে প্রায় ১০-১৫ টন গোবর, ২০০ কেজি ইউরিয়া, ১৫০ কেজি টিএসপি এবং ১৫০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। বীজ বপনের আগে একবার গোবর সার এবং টিএসপি সার মাটিতে মিশিয়ে দিতে হবে। ইউরিয়া ও এমওপি সার তিনবারে প্রয়োগ করতে হবে—প্রথমটি গাছের বৃদ্ধির সময়, দ্বিতীয়টি ফুল ফোটার সময় এবং তৃতীয়টি ফল ধরা সময়।
সেচের পদ্ধতি
শসা গাছের জন্য নিয়মিত সেচ প্রয়োজন। বীজ বপনের পরপরই প্রথম সেচ দিতে হবে। এরপর প্রায় প্রতি ৩-৫ দিন অন্তর সেচ দিতে হবে। শসা গাছের শিকড়ের কাছেই মাটি ভেজানোর জন্য স্প্রিংকলার বা ড্রিপ সেচ ব্যবস্থা সবচেয়ে ভালো কাজ করে। এতে মাটির আর্দ্রতা ঠিক থাকে এবং গাছের রোগবালাইও কম হয়। বর্ষাকালে অতিরিক্ত সেচের দরকার নেই, তবে মাটিতে জল জমতে দেওয়া উচিত নয় কারণ তাতে শিকড় পচে যেতে পারে।
শসার যত্ন ও পরিচর্যা
শসা চাষের সময় কিছুটা যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। জমির আগাছা পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে শসা গাছের পুষ্টি ক্ষতি না হয়। এছাড়াও, শসা গাছের আশেপাশে জৈব মুলচিং করে দিলে মাটির আর্দ্রতা বজায় থাকে। শসা গাছের ডালপালা ছাঁটা এবং অতিরিক্ত লতা সরিয়ে দিলে গাছের পুষ্টির ব্যবহার সঠিকভাবে হয় এবং গাছ ভালোভাবে বৃদ্ধি পায়।
রোগ ও পোকামাকড় দমন
শসা চাষে বিভিন্ন ধরনের রোগ এবং পোকামাকড় আক্রমণ করতে পারে। যেমন:
ডাউনি মিলডিউ: পাতায় সাদা আবরণ দেখা যায়। এই রোগে আক্রান্ত গাছের পাতা ঝরে পড়ে। এর জন্য কার্বেন্ডাজিম বা ডাইক্লোরোপ্রপেন কেমিক্যাল স্প্রে করা যেতে পারে।
পাউডারি মিলডিউ: গাছের পাতায় সাদা রঙের পাউডার জাতীয় স্তর পড়ে। সালফার জাতীয় কেমিক্যাল স্প্রে করলে এই রোগ প্রতিরোধ করা যায়।
লাল মাকড়সা: এই পোকা শসা গাছের পাতা ও ডালপালায় ক্ষতি করে। নিম তেল বা ইমিডাক্লোপ্রিড স্প্রে করা যেতে পারে এই পোকা দমনের জন্য।
ফলের পচন রোগ: গাছে ফল ধরার পর এই রোগে ফল পচে যেতে পারে। এজন্য কপার অক্সিক্লোরাইড স্প্রে করা যেতে পারে।
শসা সংগ্রহ এবং বাজারজাতকরণ
বীজ বপনের ৫০-৬০ দিন পর শসা সংগ্রহ করা যায়। ফল সবুজ এবং নরম থাকাকালীন শসা তুলতে হবে, কারণ শসা পাকা অবস্থায় স্বাদ হারায়। শসা সংগ্রহের সময় ফলের উপর ক্ষত না লাগানোর দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
শসা বাজারজাত করার জন্য কাঁচা অবস্থায় সংগ্রহ করা হয় এবং এর পরে শসা পরিষ্কার করে প্যাকেট করা হয়। বাজারে তোলার জন্য সতেজ শসা তুলে রাখতে হয়, কারণ শসার স্বাদ এবং চাহিদা ভালো থাকে। সরাসরি বাজারে বিক্রির পাশাপাশি বিভিন্ন প্রসেসিং কোম্পানির কাছেও শসা সরবরাহ করা যেতে পারে।
শসা চাষ কেন করবেন
শসা চাষ আমাদের দেশে অত্যন্ত লাভজনক একটি কৃষি প্রকল্প হিসেবে পরিচিত। প্রয়োজনীয় জ্ঞান এবং পরিশ্রম দ্বারা শসা চাষ করতে পারে যে কেউ। চাষ পদ্ধতি এবং সঠিক যত্ন নিশ্চিত করতে পারলে, শসা চাষ থেকে আপনি প্রচুর লাভ করতে পারেন। এখানে আমরা শসা চাষের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত বিষয় বিশদভাবে আলোচনা করবো।
শসা চাষের উপকারিতা
অর্থনৈতিক সাফল্যের সম্ভাবনা
শসা চাষে অর্থনৈতিক দিক থেকে কৃষকদের জন্য বিশেষ সুযোগ রয়েছে। কম সময়ে ফসল পাওয়া যায় এবং বাজারে এর চাহিদা বরাবরই থাকে। এ কারণে, শসা চাষে কম পুঁজি বিনিয়োগে অধিক লাভের সম্ভাবনা থাকে।
কম সময়ে ফলন
শসার ফসল তোলার সময়কাল খুবই কম। সাধারণত ৪০-৫০ দিনের মধ্যেই শসা সংগ্রহ করা যায়। তদুপরি, একবার গাছ থেকে শসা সংগ্রহ করার পরও পরবর্তী কিছু দিন আবারো ফলন হতে থাকে। ফলে অল্প সময়ে ভালো ফলনের জন্য শসা চাষ উপযুক্ত।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য
শসা একটি পুষ্টিকর খাদ্য। এতে প্রচুর পরিমাণে পানি এবং ভিটামিন থাকে, যা শরীরকে সতেজ রাখে। এছাড়া, শসা শীতলকারী এবং হজম ক্ষমতাও বাড়ায়। ফলে শসা শুধু খাদ্য হিসেবেই নয়, বিভিন্ন ধরনের হেলথ কেয়ার প্রোডাক্টেও এর ব্যবহার হয়।
শসা চাষের জন্য মাটি এবং আবহাওয়া
মাটি নির্বাচন
শসা চাষের জন্য বেলে-দোআঁশ মাটি উপযুক্ত। মাটি জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ হতে হবে এবং এর পানির সঞ্চালন ক্ষমতা ভালো হতে হবে। মাটির পিএইচ মান সাধারণত ৫.৫ থেকে ৬.৮ এর মধ্যে হলে শসা চাষ ভালো হয়। মাটি ঝুরঝুরে হলে শিকড়ের বৃদ্ধি দ্রুত হয় এবং ফসলও ভালো হয়।
আবহাওয়া
শসা চাষের জন্য উষ্ণ আবহাওয়া প্রয়োজন। সাধারণত ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা শসা চাষের জন্য আদর্শ। শীতল আবহাওয়ায় শসা ভালো হয় না এবং তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেশি হলে পোকামাকড়ের সংক্রমণ বেশি হয়।
আরও জানুন –শীতকালীন শিম চাষ পদ্ধতি সহজ কৌশল ও পরামর্শ
শসা চাষের জন্য বীজের প্রস্তুতি
বীজ নির্বাচন ও সংরক্ষণ
ভালো মানের বীজ নির্বাচন শসা চাষের প্রথম ধাপ। উচ্চ ফলনশীল এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন বীজ নির্বাচন করতে হবে। বাজার থেকে ভালো মানের সংকর বা উন্মুক্ত পরাগিত জাতের বীজ পাওয়া যায়।
বীজ রোপণ প্রক্রিয়া
বীজ বপনের জন্য মাটিকে ১-২ সেন্টিমিটার গভীরে খুঁড়তে হবে এবং প্রতিটি গর্তে ১-২টি বীজ দিতে হবে। গর্তগুলোর মধ্যে ৫০ সেমি দূরত্ব রাখতে হবে এবং সারি ও সারির মধ্যে ১ মিটার দূরত্ব রাখা উচিত।
শসা গাছের যত্ন
সার ও পানির প্রয়োজন
শসা গাছের জন্য অর্গানিক সার ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি হেক্টর মাটিতে কম্পোস্ট সার, গোবর সার ইত্যাদি যোগ করতে হবে।
শসার গাছের জন্য নিয়মিত পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। গাছের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিদিন একবার বা দুইবার পানি দিতে হবে। তবে, অতিরিক্ত পানি জমে গেলে গাছের শিকড় পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
রোগ প্রতিরোধ ও পোকামাকড় নিয়ন্ত্রণ
শসা গাছে সাধারণত বিভিন্ন ধরনের পোকামাকড় এবং রোগ আক্রমণ করতে পারে, যেমন- বেলে পোকার আক্রমণ, পাউডারি মিলডিউ, ডাউন মিলডিউ ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে জৈব কীটনাশক এবং সঠিক যত্ন রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
ফসল সংগ্রহ
শসার ফলন সাধারণত বপনের ৪০-৫০ দিন পর হতে শুরু হয়। শসার আকার এবং রং দেখে ফল সংগ্রহ করা হয়। শসার গায়ে চিহ্ন বা দাগ দেখা দিলে দ্রুত সংগ্রহ করতে হবে।
বাজারজাতকরণ
শসার চাহিদা সারা বছর থাকে। স্থানীয় বাজার ছাড়াও সুপারশপ এবং রপ্তানি মাধ্যমে শসার চাহিদা মেটানো যায়। ভালো মানের শসা উৎপাদন করে উপযুক্ত মূল্য পাওয়া সম্ভব।
লেখক এর মন্তব্ব
শসা চাষ একটি সহজ এবং লাভজনক কৃষি পদ্ধতি। লেখক মনে করেন, সঠিক মাটি নির্বাচন, উচ্চ মানের বীজ ব্যবহার, এবং পর্যাপ্ত যত্নের মাধ্যমে শসা চাষে অধিক ফলন এবং লাভ নিশ্চিত করা যায়। তদ্ব্যতীত, শসা চাষে পোকামাকড় ও রোগ প্রতিরোধে জৈব কীটনাশকের ব্যবহারও গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছেন। চাষাবাদের শুরু থেকে ফসল সংগ্রহ এবং বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে সুপরিকল্পিত পদ্ধতি মেনে চললে শসা চাষে সাফল্য অর্জন সম্ভব।
লেখক পরিচিতি
সাম্প্রতিক পোস্ট
- কৃষি টিপসOctober 30, 2024শসা চাষ পদ্ধতি ও সঠিক যত্ন
- কৃষি টিপসOctober 30, 2024শীতকালীন শিম চাষ পদ্ধতি সহজ কৌশল ও পরামর্শ