চায়না ৩ লিচু চাষ পদ্ধতি

চায়না ৩ লিচু চাষ পদ্ধতি

আমাদের আজকের কৃষি টিপস চায়না ৩ লিচু চাষ পদ্ধতি নিয়ে যাতে নতুন প্রজন্মের কৃষি উদ্যোক্তারা এর চাষাবাদ পদ্ধতি নিয়ে ব্যপক জ্ঞান অর্জন করতে পারে। সবাই পড়ে শেয়ার করে দিবেন অন্য কৃষি উদ্যোক্তাদের মাঝে যাতে তারাও শিখতে পারে।

বাংলাদেশে অনেক ফল চাষ হয় এবং আম, জাম, কাঠাল তারপরেই আমরা বলি লিচু। তাই আজকে আমরা আলোচনা করবো চায়না ৩ লিচু চাষ পদ্ধতি নিয়ে।

চায়না ৩ লিচু চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত

চায়না-৩ লিচু জুন মাসের শেষ সপ্তাহে পাকে, এবং পাকার পর খোসার রঙ পুরোপুরি লাল হয় না, লালের মধ্যে কমলা রঙের ছোপ থাকে, অর্থাৎ পাকা অবস্থায় কাচা কাচা ভাব নেয়। এই জাতের ফল কাচা ও পাকা অবস্থায় বেশ মিষ্টি ও স্বাদে অতুলনীয়, শাঁস সাদা, অত্যন্ত মিষ্টি, রসাল, নরম, সুগন্ধযুক্ত ও পুরু। এই লিচুর বীজ খুব ছোট হয় এবং পরিপক্কতার সাথে সাথে বীজ শুকাতে থাকে এবং চিকন ও লম্বা হয়।

পাতার আকার মধ্যম আকারের ও অনেকটা দুই দিকে মোড়ানো নৌকার মত দেখা যায়। চায়না ৩ জাতের লিচু ফল বড় হওয়ার পর অর্থাৎ ফল পুষ্ট হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে ফাটা শুরু করে। সাধারণত এই জাতের লিচু গুটি কলমের হয়ে থাকে তাই চারা বেশ দুর্বল হওয়ায় নিয়মিত সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং বেশি যত্নের দরকার পরে।

অন্যান্য জাতের থেকে এই জাতে পোকার আক্রমন তুলনামুলক বেশি হয়ে থাকে।

চায়না ৩ (ইংরেজি: China 3) লিচু ফলের একটি প্রকারভেদ হল চায়না ৩ বিজ্ঞানীরা নানা জাতের লিচু উদ্ভাবন করেছেন, তার মধ্যে ‘চায়না ৩’ জাত রয়েছে। চায়না-৩ লিচুটি বারি লিচু-৩ নামেও পরিচিত। এটি একটি নাবী (সবশেষে পাওয়া যায়) জাতের লিচু এবং লিচুর সকল জাতের মধ্যে আকার, কোষের গড়ন এবং স্বাদের বিচারে বর্তমানে এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে উন্নত জাত। দেশের উত্তারাঞ্চলে এ জাতটি চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী।

আরও পড়ুন   লাভজনক কৃষি ব্যবসা আইডিয়া

এ জাতের গাছ ছোট থেকে মাঝারি আকারের হয়ে থাকে, গড় উচ্চতা প্রায় ৫ থেকে ৬ মিটার হয়। গাছপ্রতি গড় ফলন ১০৪ কেজি, তবে প্রতিবছরই বা নিয়মিতভাবে ফল ধরেনা।এ জাতের লিচু ফল মোটামুটি বড় গোলাকার হয় এবং গড় ওজন প্রায় ২৫-৩০ গ্রাম টিএসএস-১৮%। খাবারযোগ্য অংশ ও বীজের সমানুপাত ১৫ঃ ১।

নিকাশযুক্ত উর্বর বেলে দোআঁশ মাটি লিচু চাষের জন্য উত্তম। তবে উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে লিচুর চাষ ভাল হয়।

জাতের ওপর লিচুর ফলন ও স্বাদ বহুলাংশে নির্ভর করে।বাংলাদেশে চাষকৃত লিচুর মধ্যে চায়না-৩ হল সবচেয়ে ভালো জাত।চায়না-৩ জাতের লিচু বর্তমানে দেশের প্রায় সব জেলাতেই কম-বেশি চাষ হচ্ছে কিন্তু বৃহত্তর রাজশাহী, দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশোর, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ ও চট্টগ্রাম জেলায় বেশি পরিমাণে লিচু উৎপন্ন হয়।

এমনকি বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকাতেও এ জাতের লিচুর চাষ এবং ফলন দিন দিন বেড়ে চলেছে।

চায়না-৩ লিচুর অযৌন বংশবিস্তারের জন্য গুটি কলম একটি চমত্কার প্রক্রিয়া হিসেবে সর্বত্র স্থানেই স্বীকৃত। রোগ ও পোকা মাকড় মুক্ত স্বাস্থ্যবান গাছের এক বছর বয়সের ডালে গুটিকলম করা হয়। মে–জুন মাস চায়না-৩ লিচুর গুটি কলম বাঁধার উপযুক্তসময়।

শিকড় আসতে প্রায় দু’মাস সময় নেয়। চায়না-৩ লিচু চাষ করতে হলে উঁচু বা মধ্যম উঁচু জমি বাছাই করতে হবে। চাষের মাধ্যমে জমি সমপৃষ্ঠ এবং আগাছামুক্ত করতে হবে।

china 3

বাসস্থানের খালি জায়গাতে দু’একটি গাছ রোপণ করতে চাইলে জমি প্রস্তুত না করে সরাসরি গাছ রোপণ করলেই হবে। সমতল ভূমিতে বর্গাকার প্রক্রিয়াতে রোপণ করাই শ্রেয়। পাহাড়ী এলাকায় কন্টুর পদ্ধতিতে গাছ রোপণ করা হয়ে থাকে। এক বছর বয়ষ্ক সুস্থসবল গুটি কলমের চারা নির্বাচন করতে হবে।

বড় চারা রোপণ না করাই শ্রেয়।মধ্য–মে থেকে মধ্য-জুলাই এবং মধ্য-আগস্ট থেকে মধ্য-সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত চারা রোপণ করা যায়। ৮ মিটার × ৮ মিটার কিংবা ১০ মিটার × ১০ মিটার ব্যবধানে চারা বপন করতে হবে। গর্তের আকার: ১ মিটার × ১ মিটার × ১ মিটার হওয়া প্রয়োজন।

আরও পড়ুন   হাইব্রিড মিষ্টি কুমড়া চাষ পদ্ধতি

চারা রোপণের ১০–১৫ দিন আগে গর্ত তৈরি করতে হবে এবং সার ও মাটি মিশিয়ে গর্তটি ভরাট করতে হবে। চারা বপণের সময় সাবধানে চারাটি গোড়ার মাটিরবল সহ গর্তের মাঝামাঝি সোজাভাবে লাগাতে হবে। চারা রোপণের করার পর পানি, খুটি ও চারার প্রতিরক্ষা হিসেবে বেড়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

কিংবাণের ৬ মাস পরে ইউরিয়াসার উপরি প্রয়োগ করতে হয়। প্রত্যেকটি গাছেই ইটের বা বাঁশের ঘের দেয়া প্রয়োজন। একটি পূর্ণ বয়সের ফলন্ত গাছের জন্য বাৎসরিক মাত্রা অনুযায়ী সার প্রয়োগকরতে হবে। বর্ষার আগে বা বর্ষার পরে সার উপরি প্রয়োগ করা বাঞ্ছনীয়।

চারা তৈরির নিয়ম:

কাটিং ও গুটি কলমের মাধ্যমে চারা তৈরি করা হয়।

চারা রোপণ পদ্ধতি :

জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাস কলমের চারা রোপণের উপযুক্ত সময়। ৮-১০ মিটার দূরে দূরে চারা রোপণ করতে হয়। চারা রোপণের সময় গর্তে কিছুটা পুরাতন লিচু বাগানের মাটি মিশিয়ে দিলে চারার অভিযোজন দ্রুত হবে।

সার ব্যবস্থাপনার নিয়ম:

প্রতি গর্তে টিএসপি সার ৭০০ গ্রাম, এমওপি সার ৪৫০ গ্রাম, জিপসাম সার ৩০০ গ্রাম, জিংক সালফেট ৬০ গ্রাম ও জৈবসার ২৫ কেজি দিতে হয। গর্ত ভর্তির ১০-১৫ দিন পর মাটির বলসহ গর্তের মাঝখানে সোজাবাবে লাগাতে হবে। রোপণের ৩ মাস পর ৩০০-৩৫০ গ্রাম ইউরিয়া সার প্রয়োগ করা দরকার।

লিচু গাছে সার প্রয়োগ
লিচু গাছে সার প্রয়োগ

পূর্ণ বয়স্ক ফলন- গাছের জন্য ইউরিয়া সার ২ কেজি, টিএসপি সার ৩.৫ কেজি, এমওপি সার ২ কেজি, জিপসাম সার ২৬০ গ্রাম, জিংক সালফেট সার ৬০ গ্রাম, গোবর ১৫ কেজি এবং ৯ কেজি ছাই প্রয়োগ করতে হয়।

অন্তবর্তীকালীন পরিচর্যা:

পূর্ণ বয়স্ক গাছে পর্যাপ্ত আলো বাতাস প্রবেশের জন্য অপ্রয়োজনীয় ডালপালা কেটে ফেলতে হবে। কলমের গাছের বয়স ৪ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মুকুল ভেঙ্গে দেয়া দরকার।

সেচ ও আগাছা ব্যবস্থাপনা:

চারা গাছের বৃদ্ধির জন্য ঘন ঘন সেচ দিতে হবে। তাছাড়া গাছের গোড়া আগাছা মুক্ত রাখতে হবে।

পোকা মাকড় ব্যবস্থাপনা

পোকার নাম: লিচুর ফল ছিদ্রকারী পোকা

আরও পড়ুন   আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত, লাভজনক ফল চাষের সঠিক নির্দেশিকা

লিচুর সমস্যা

ভূমিকা: এটি লিচুর একটি ক্ষতিকারক পোকা। এর আক্রমণে লিচুর বাজার মূল্য কমে যায়।

ক্ষতির নমুনা: ফল পরিপক্ক হওয়ার সময় এ পোকা ফলের বোঁটার নিকট দিয়ে ভিতরে ঢুকে বীজ খেতে থাকে। এরা ফলের শাঁস খায় না তবে বোঁটার কাছে বাদামী রংয়ের এক প্রকার করাতের গুড়ার মত পদার্থ উৎপন্ন করে।

ব্যবস্থাপনা: এ পোকা দমনের জন্য ফল ধরার পর লিবাসিড ৫০ তরল বা ফেনিট্রোথিয়ন ৫০ তরল অথবা টোসিটকস আর ২৫ তরল এর যেকোন একটি প্রতি লিটার পানিতে ১ মি.লি হারে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২ থেকে ৩ বার সেপ্র করতে হবে। তবে মনে রাখতে হবে ফল সংগ্রহের অন্তত: ১৫ দিন পূর্বে শেষ সেপ্র করতে হবে।

মাকরের নাম: লিচুর পাতার ক্ষুদ্র মাকড়

ভূমিকা: লিচু গাছের পাতা, ফুল ও ফলে এর আক্রমণ দেখা যায়।

ক্ষতির নমুনা: আক্রান্ত পাতা কুঁকড়িয়ে যায় এবং পাতার নীচের দিক লাল মখমলের মত হয়। পরবর্তীতে পাতা দুর্বল হয়ে মরে যায় এবং ডালে ফুল, ফল বা নতুন পাতা হয় না। আক্রান্ত ফুলে ফল হয় না।

ব্যবস্থাপনা: আক্রান্ত পাতা সংগ্রহ করে পুড়িয়ে ফেলা। ইথিয়ন ৪৬.৫ তরল বা নিউরণ ৫০০ তরল ২ মি.লি হারে প্রতি লিটার পানিতে মিশিয়ে আক্রান্ত গাছে ভালভাবে সেপ্র করা।

ফসল তোলা বা লিচু সংগ্রহ:

লিচু সংগ্রহ

ফলের খোসার কাঁটা চ্যাপ্টা হয়ে যখন মসৃণ হয় এবং ফলের গায়ে লালচে বর্ণ ধারণ করে তখন কিছু পাতাসহ ডাল ভেঙ্গে রিচু থোকায় থোকায় সংগ্রহ করতে হবে।

আর্টিকেল টি পড়ে ভালো লাগলে শেয়ার করে দিন অন্য বন্ধুদের মাঝে। যাতে তারাও এই তথ্যটি পেতে পারে।

 

লেখক পরিচিতি

Iqbal Hossain Shimul
Iqbal Hossain Shimul
আমি ইকবাল হোসেন শিমুল একজন ফ্রিল্যান্স ব্লগার আর্টিকেল রাইটার। আর্টিকেল রাইটিং এবং এস ই ও এর উপর কাজ করছি প্রায় ১০ বছর যাবত।
পোস্ট টি শেয়ার করে দিন