আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত, লাভজনক ফল চাষের সঠিক নির্দেশিকা

আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি বিস্তারিত, লাভজনক ফল চাষের সঠিক নির্দেশিকা

বাংলাদেশে বিভিন্ন রকমের ফল চাষ হলেও আঙ্গুর চাষ তুলনামূলকভাবে কম পরিচিত। কিন্তু সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে আঙ্গুর চাষ একটি লাভজনক কৃষি ব্যবসায় পরিণত হতে পারে। আঙ্গুর একটি অত্যন্ত পুষ্টিকর ফল, যা তাজা খাওয়া যায় এবং রস, জেলি ও বিভিন্ন মিষ্টান্ন তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এই আর্টিকেলে, আমরা আঙ্গুর চাষ পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো, যা আপনাকে এই চাষে সফল হতে সাহায্য করবে।

আঙ্গুর চাষের উপযুক্ত জলবায়ু ও মাটি

১. জলবায়ু:

আঙ্গুরের ভালো ফলনের জন্য উষ্ণ ও শুষ্ক জলবায়ু প্রয়োজন। বাংলাদেশে শীতকালে আঙ্গুর গাছ ভালোভাবে বেড়ে ওঠে, তবে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা খুব বেশি বেড়ে গেলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হতে পারে। আঙ্গুর গাছের জন্য ২৫-৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা আদর্শ।

২. মাটি:

আঙ্গুর গাছের জন্য ভাল নিষ্কাশনযুক্ত মাটির প্রয়োজন। দোআঁশ মাটি এবং বেলে দোআঁশ মাটি আঙ্গুর চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। মাটির পিএইচ মান ৬-৭ এর মধ্যে হলে আঙ্গুর গাছ সবচেয়ে ভালো ফলন দেয়। জমিতে অতিরিক্ত পানি জমে থাকলে আঙ্গুর গাছের শিকড় পচে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাই জমি বেছে নেওয়ার সময় এ বিষয়টি অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে।

আরও পড়ুন   মিষ্টি কুমড়া চাষের সময়

আরও জানুন –সফল হতে যে ৩টি কৃষি ব্যবসায় মনোযোগ দিবেন

আঙ্গুর চাষের প্রাথমিক প্রস্তুতি

১. জমি নির্বাচন:

জমি নির্বাচন
 

আঙ্গুর চাষের জন্য উঁচু এবং সূর্যালোকযুক্ত জমি নির্বাচন করতে হবে। জমির চারপাশে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবাহ থাকলে গাছ ভালোভাবে বেড়ে উঠবে। মাটির উর্বরতা বাড়ানোর জন্য আগে থেকেই জৈব সার বা গোবর সার ব্যবহার করতে হবে। জমি চাষের সময় ২-৩ বার ভালোভাবে হাল চাষ করে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে।

২. চারা সংগ্রহ:

আঙ্গুর চাষে উন্নতমানের চারা নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নত জাতের চারা লাগালে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পাবে এবং ফলনও ভালো হবে। বাজার থেকে ভালো মানের কলম জাতের চারা সংগ্রহ করা যেতে পারে অথবা নিজেই কলমের মাধ্যমে নতুন চারা তৈরি করা সম্ভব।

আঙ্গুর চাষের পদ্ধতি

১. চারা রোপণ:

জমি প্রস্তুতির পর চারার জন্য ২-৩ ফুট গভীর গর্ত তৈরি করতে হবে। গর্তগুলির মধ্যে দূরত্ব ৮-১০ ফুট রাখতে হবে, যাতে গাছগুলির মধ্যে পর্যাপ্ত স্থান থাকে এবং সঠিকভাবে বৃদ্ধি পায়। গর্তে গোবর সার, জৈব সার এবং কিছু রাসায়নিক সার মিশিয়ে চারা রোপণ করতে হবে। চারা লাগানোর পর মাটি ভালোভাবে চেপে দিতে হবে এবং পর্যাপ্ত পানি দিতে হবে।

২. সার প্রয়োগ:

আঙ্গুর গাছের ভালো ফলনের জন্য নিয়মিত সার প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। জৈব সার যেমন গোবর সার, ভার্মিকম্পোস্ট, এবং রাসায়নিক সার যেমন ইউরিয়া, টিএসপি, এমওপি প্রয়োগ করা যেতে পারে। বিশেষ করে ফল আসার সময় নিয়মিতভাবে সার প্রয়োগ করতে হবে, যাতে ফলন ভালো হয় এবং গুণগত মান বজায় থাকে।

৩. পানি সেচ ব্যবস্থা:

আঙ্গুর গাছের জন্য পানি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে অতিরিক্ত পানি দিলে গাছের শিকড় পচে যেতে পারে। চারা রোপণের পর প্রথম ৩-৪ মাস নিয়মিত পানি দিতে হবে। তবে বর্ষাকালে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে জমিতে পানি জমে না থাকে। শীতকালে গাছের চারপাশে মালচিং করে দিলে মাটির আর্দ্রতা বজায় থাকে এবং গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

আরও পড়ুন   বারি-১১ আম চাষ পদ্ধতি, লাভজনক ও সঠিক ব্যবস্থাপনা

আঙ্গুর গাছের যত্ন

 

১. গাছের ডাল ছাঁটাই:

আঙ্গুর গাছের ফলন বাড়াতে প্রতি বছর ডাল ছাঁটাই করা জরুরি। গাছের অপ্রয়োজনীয় ও রোগাক্রান্ত ডালপালা ছাঁটাই করে দিলে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং নতুন ফল ধরে। সাধারণত শীতকালের শেষে গাছের ডাল ছাঁটাই করতে হয়।

২. রোগবালাই দমন:

আঙ্গুর গাছে রোগবালাই আক্রমণ করলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। আঙ্গুর গাছে সাধারণত ফাঙ্গাস, ছত্রাক এবং ভাইরাস জনিত রোগ বেশি দেখা যায়। এসব রোগ থেকে গাছকে রক্ষা করার জন্য প্রতিরোধক কীটনাশক ব্যবহার করতে হবে। এছাড়া গাছের চারপাশে আগাছা থাকলে তা পরিষ্কার রাখতে হবে।

৩. পোকামাকড় দমন:

আঙ্গুর গাছে বিভিন্ন পোকামাকড়ের আক্রমণ হতে পারে। বিশেষ করে পাতামাকড়, লেদা পোকা এবং ফলমাছি আঙ্গুর গাছের জন্য ক্ষতিকারক। এসব পোকা দমনের জন্য প্রয়োজনীয় বায়ো কীটনাশক বা রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

আঙ্গুর সংগ্রহ ও সংরক্ষণ

আঙ্গুর সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
 

১. ফল সংগ্রহ:

আঙ্গুর গাছ রোপণের ২-৩ বছরের মধ্যে ফল দেয়। গাছের ফল পূর্ণতা পেলে তা সংগ্রহ করা উচিত। আঙ্গুরের গুণগত মান বজায় রাখতে ফলের রঙ, আকার এবং স্বাদ দেখে সঠিক সময়ে সংগ্রহ করতে হবে। সাধারণত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আঙ্গুর ফল সংগ্রহ করা হয়।

২. ফল সংরক্ষণ:

আঙ্গুর একটি নরম ফল, তাই এটি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। ফল সংগ্রহের পর তা ঠাণ্ডা স্থানে সংরক্ষণ করতে হবে। আঙ্গুর দীর্ঘ সময়ের জন্য সংরক্ষণ করতে হলে ফ্রিজ বা কোল্ড স্টোরেজ ব্যবহার করা উচিত।

আঙ্গুর চাষের অর্থনৈতিক দিক

আঙ্গুর চাষ অত্যন্ত লাভজনক একটি ব্যবসা। সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে কম সময়ে অনেক বেশি মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। বর্তমানে বাজারে আঙ্গুরের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে, বিশেষ করে শহরাঞ্চলে। তাজা আঙ্গুর, আঙ্গুরের রস এবং আঙ্গুরের শুকনো ফর্ম (কিসমিস) রপ্তানি করেও প্রচুর মুনাফা করা সম্ভব।

আরও পড়ুন   ছাদে বাগান করার সঠিক পদ্ধতি

১. বিনিয়োগ:

আঙ্গুর চাষে প্রাথমিকভাবে জমি প্রস্তুত, চারা সংগ্রহ, সার, কীটনাশক এবং সেচের জন্য কিছু বিনিয়োগ প্রয়োজন। তবে একবার বিনিয়োগ করলে আঙ্গুর গাছ ১৫-২০ বছর পর্যন্ত ফল দিতে থাকে, যা দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক।

২. আয়:

আঙ্গুর চাষ থেকে প্রতি বছর ভালো আয় করা সম্ভব। প্রতিটি গাছ থেকে প্রায় ২০-২৫ কেজি ফল পাওয়া যায়। আঙ্গুরের বাজার মূল্য বেশি থাকায় এটি থেকে সহজেই লাভবান হওয়া যায়। এছাড়া রপ্তানির মাধ্যমে আঙ্গুর চাষ আরও লাভজনক হয়ে উঠছে।

আঙ্গুর চাষের চ্যালেঞ্জ ও সমাধান

চ্যালেঞ্জ:

১. আঙ্গুর চাষে বড় চ্যালেঞ্জ হল রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ। ২. প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন অতিবৃষ্টি বা খরা আঙ্গুর গাছের ক্ষতি করতে পারে। ৩. অনেক কৃষক আঙ্গুর চাষ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকায় সফল হতে পারেন না।

সমাধান:

১. নিয়মিত কীটনাশক এবং ফাঙ্গাস প্রতিরোধক ব্যবহার করলে গাছকে রোগবালাই থেকে রক্ষা করা যায়। ২. সঠিক সেচ ব্যবস্থা এবং ড্রেনেজ সিস্টেম বজায় রেখে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতি কমানো সম্ভব। ৩. আঙ্গুর চাষে সফল হতে হলে সঠিক প্রশিক্ষণ ও গবেষণার মাধ্যমে আধুনিক পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে।

আঙ্গুর চাষ বাংলাদেশের কৃষি খাতে একটি উদীয়মান ব্যবসা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। সঠিক পদ্ধতিতে চাষ করলে এটি থেকে দীর্ঘমেয়াদী লাভবান হওয়া যায়। মাটি, জলবায়ু, সার ও সেচের সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং নিয়মিত যত্ন নিলে আঙ্গুর চাষে সাফল্য নিশ্চিত করা সম্ভব। আঙ্গুরের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে, তাই এই ফল চাষে বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখা যেতে পারে।

লেখক পরিচিতি

Nahid Islam
Nahid Islam
আমি নাহিদ ইসলাম ফ্রি-ল্যান্স আর্টিকেল রাইটার হিসাবে কাজ করছি প্রায় ২ বছর।
পোস্ট টি শেয়ার করে দিন